শতভাগ লুটপাটের দখলে ক্রীড়া কর্মসূচি প্রকল্প

বাংলাদেশে ক্রীড়ার প্রসার, উন্নয়ন ও মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর সাড়া দেশের ৬৪ জেলায় বাস্তবায়ন হয় বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি প্রকল্প। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ক্রীড়া পরিদপ্তর এ প্রকল্পের দায়িত্বে।

শতভাগ লুটপাটের দখলে ক্রীড়া কর্মসূচি প্রকল্প

বাংলাদেশে ক্রীড়ার প্রসার, উন্নয়ন মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর সাড়া দেশের ৬৪ জেলায় বাস্তবায়ন হয় বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি প্রকল্প। যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ক্রীড়া পরিদপ্তর প্রকল্পের দায়িত্বে। পরিকল্পনায় বলা হয়, তৃণমূল থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেছে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক দল তৈরি করা হবে। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্প শুধু কাগজেই থেকে গেছে। মাঠে কার্যক্রম নেই, বরাদ্দের টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়েছে কর্মকর্তাদের মধ্যে। অভিযোগ আছে, ১০০ ভাগ টাকাই আত্মসাৎ হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।

এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। বরাদ্দের টাকার হিসাব আগে থেকেই শেষ দেখানো হয়। একই বিল-ভাউচার দিয়ে একাধিকবার টাকা তোলা হয়। নামপরিচয়হীন প্রশিক্ষকদের নামে সম্মানীর বিল করা হয়। পুরোনো মাস্টাররোল ব্যবহার করে বছর বছর নতুন বরাদ্দ তোলা হয়। অথচ ক্রীড়া পরিদপ্তরে প্রচুর জনবল থাকা সত্ত্বেও মাঠপর্যায়ে কোনো সাফল্য নেই।

এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম ক্রীড়া পরিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আলীমুজ্জামান। অভিযোগের বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি টাকা নিছি তাহলে দপ্তর প্রধান কি আঙুল চুষছে? দপ্তর প্রধান কে, সে কী করছে তার কাছে জিজ্ঞাসা করেন।পরে আরও প্রশ্ন করা হলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘যে চোর তার কাছে জিজ্ঞেস করলে কি আপনি পাবেন?’ এরপর তিনি সাবেক পরিচালক তরিকুল ইসলামের নাম টেনে এনে বলেন, ‘ওর কাছে আরও অভিযোগ আছে, ওর কাছ থেকে নিয়ে আসেন।

প্রকল্পের বরাদ্দ: ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের প্রতিটি জেলায় প্রকল্পে লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিভাগীয় আটটি জেলায় বরাদ্দ ছিল আরও লাখ ৫০ হাজার টাকা করে। কিন্তু এক টাকাও প্রকৃত অর্থে খরচ হয়নি বলে তদন্তে ধরা পড়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও টাকাগুলো ভাগ করে নেওয়া হয়েছে কর্মকর্তাদের মধ্যে।

ক্রীড়া পরিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (যুগ্ম সচিব) তরিকুল ইসলাম নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত চালান। তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো অর্থ ব্যয় হয় না। কার্যক্রম কাগজে দেখানো হয়, মাঠে নয়। বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেন জেলা ক্রীড়া অফিসাররা।

আগেই দেখানো খরচ: তদন্তে দেখা গেছে, বরাদ্দ প্রদানের আগেই ব্যয়ের হিসাব দেখানো হয়।

উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ক্রীড়া পরিদপ্তরে অর্থ বরাদ্দ আসে। ২০ ডিসেম্বর তা ৬৪ জেলার অফিসে পাঠানো হয়। অথচ এর আগেই চট্টগ্রামে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেখানো হয়েছে অক্টোবর মাসে। ঢাকা জেলায় সাঁতার প্রশিক্ষণ দেখানো হয়েছে থেকে ৩০ অক্টোবর। গোপালগঞ্জে ফুটবল প্রশিক্ষণ শেষ দেখানো হয়েছে ১৩ ডিসেম্বর। ফেনীতে অ্যাথলেটিকস প্রশিক্ষণ সম্পন্ন দেখানো হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে।

নথিপত্রে জালিয়াতি: আগের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের মাস্টাররোল ব্যবহার করে নতুন বরাদ্দের বিল তোলা হয়েছে। কোনো কোনো মাস্টাররোলে এক জায়গায় লেখা সোনাগাজী উপজেলা, আবার অন্য পৃষ্ঠায় লেখা দাগনভূঞা উপজেলা। এক জায়গায় লেখা ভলিবল প্রশিক্ষণ, আবার অন্য জায়গায় লেখা সাঁতার প্রশিক্ষণ।

কোথাও সাঁতার প্রশিক্ষণের ভাউচারে লেখা ফেনী সদর উপজেলা, অথচ মাস্টাররোলে লেখা সোনাগাজী উপজেলা। কোথাও প্রশিক্ষণের খরচ ৩০ অক্টোবর দেখানো হলেও বরাদ্দ এসেছে ডিসেম্বরের শেষে।

ভুয়া মাস্টাররোলে টাকা তোলা: তদন্তে ধরা পড়ে, জেলা ক্রীড়া অফিসাররা নিজেরাই প্রশিক্ষণার্থীদের নাম লিখে মাস্টাররোল বানিয়ে জমা দেন। সব স্বাক্ষর এক হাতেই করা। এভাবে পটুয়াখালীর শাপাতুল ইসলাম তুলেছেন ৯৪ হাজার ৫০০ টাকা, ঝালকাঠির হুসাইন আহমেদ তুলেছেন ৭৫ হাজার ৬০০, গোপালগঞ্জের মনিরুজ্জামান তুলেছেন ২৪ হাজার, চট্টগ্রামের হারুন ওর রশীদ তুলেছেন ৬০ হাজার, ঢাকার রেজাউল করিম তুলেছেন ৬৩ হাজার, নাটোরের রফিকুল ইসলাম তুলেছেন ৭৫ হাজার, বগুড়ার মাসুদ রানা তুলেছেন ৮২ হাজার ৪০০, রাজশাহীর জাহাঙ্গীর হোসেন তুলেছেন ১২ হাজার ৬০০, নওগাঁর আবু জাফর মাহমুদুজ্জামান তুলেছেন হাজার ৭৫০, খুলনার জেলা ক্রীড়া অফিসার তুলেছেন হাজার ৩৬০ এবং জয়পুরহাটের আবু জাফর মাহমুদুজ্জামান তুলেছেন হাজার ৮৭৫ টাকা।

তদন্তে বলা হয়েছে, এভাবে সারা দেশেই একই পদ্ধতিতে অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে।

লুটপাটের সিন্ডিকেট: তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লুটপাটের নিয়ন্ত্রক ক্রীড়া পরিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আলীমুজ্জামান, ফেরদৌস আলম, আজিম হোসেনসহ একাধিক কর্মকর্তা। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন জেলা ক্রীড়া অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন, মনিরুজ্জামান, নাজিম উদ্দীন ভূঁইয়া, তানভীর হোসেন, মাসুদ রানা, আব্দুল বারী, আল আমিন (ময়মনসিংহ), হুসাইন আহমেদ, মাজহারুল মজিদ হারুন ওর রশীদ। এই সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে নাম এসেছে সাবেক উপপরিচালক আক্তারুজ্জামান রেজা তালুকদারের।

তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগসরকারি অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার আগেই খরচ দেখিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসে পাঠানো হয়। যেমন ঢাকা জেলার ক্রীড়া অফিসার রেজাউল করিম ৩০ অক্টোবরের মধ্যেই ব্যয় প্রতিবেদন জমা দেন, অথচ বরাদ্দ এসেছে ২০ ডিসেম্বর।

ভুয়া ভাউচারের খেলা: অফিসাররা নিজেরাই অফিসে বসে কম্পিউটারে ভুয়া ভাউচার তৈরি করেন। এসব ভাউচারে কোনো স্বাক্ষর থাকে না। পরে সেগুলো দাখিল করে পুরো বরাদ্দের টাকা তোলা হয়। এমনকি আগের বছরের ভাউচারও নতুন করে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন হারুন ওর রশীদ ফেনী জেলায় অ্যাথলেটিকস প্রশিক্ষণের যে ভাউচার ব্যবহার করেছেন, সেটি আসলে ২০২০-২১ অর্থবছরের।

প্রশিক্ষণের ভাউচার প্রতিযোগিতায়, প্রতিযোগিতার ভাউচার প্রশিক্ষণে ব্যবহার করারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন চট্টগ্রামে সাঁতার প্রতিযোগিতার ভাউচার সাঁতার প্রশিক্ষণে ব্যবহার করেছেন হারুন অর রশীদ। নারায়ণগঞ্জে প্রতিযোগিতার ভাউচার প্রশিক্ষণের কাগজে ব্যবহার করেছেন হীরা আক্তার।

ক্রীড়া সামগ্রী আত্মসাৎ: প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য বরাদ্দ করা ক্রীড়া সামগ্রীও আত্মসাৎ করা হয়েছে। ঢাকার জেলা ক্রীড়া অফিসের রেজিস্টার ঘেঁটে দেখা যায়, বিনামূল্যে বিতরণের জন্য কেনা সামগ্রী অফিস সহকারী মালেকা বেগমকে বুঝিয়ে দিয়েছেন জেলা ক্রীড়া অফিসার রেজাউল করিম। রাজশাহীতে সাবেক অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন ইউনিসেফের ফান্ডে বাস্তবায়িত সাঁতার প্রকল্পকে সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে মিলিয়ে বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

সাদা ভাউচারের সিন্ডিকেট: জেলা ক্রীড়া অফিসারদের মালিকানাধীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাদা ভাউচার ব্যবহার করেও টাকা তোলা হয়। ঢাকা জেলা ক্রীড়া অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন এবং ঢাকা সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজের প্রভাষক আব্দুল বারীর যৌথ মালিকানাধীনভাই ভাই খেলাঘর’, ‘বি. টেক্সবিজনেস ওয়ার্ল্ডনামে তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত সাদা ভাউচার সরবরাহ করা হতো। এগুলোয় ইচ্ছামতো টাকার অঙ্ক লিখে দাখিল করে আত্মসাৎ করেন অফিসাররা।

ফেনীর দায়িত্বে থাকা হারুন অর রশীদ এভাবে তিনটি প্রশিক্ষণের পুরো বরাদ্দ লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছেন। তার দাখিলকৃত অধিকাংশ ভাউচার ছিল আগের বছরের।

অভিযুক্তদের প্রতিক্রিয়া: অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক উপপরিচালক আক্তারুজ্জামান রেজা তালুকদার বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে সৎ অফিসার।তবে সহকারী পরিচালক আলীমুজ্জামান সরাসরি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি টাকা নিছি, তাহলে দপ্তর প্রধান কি আঙুল চুষছে?’ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি এটিকেচুরিবলে উল্লেখ করেছেন।

বর্তমান কর্তৃপক্ষের অবস্থান: ক্রীড়া পরিদপ্তরের বর্তমান পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোস্তফা জামান বিষয়ে বলেন, ‘ফোনে এভাবে কথা বলা কঠিন। বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করছে। যদি কোনো ত্রুটি পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে বের করা এবং জাতীয় পর্যায়ে তাদের নিয়ে আসা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় প্রকল্পটি এখন শুধু দুর্নীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। মাঠে কার্যক্রম নেই, নেই কোনো দৃশ্যমান সাফল্য।

যে অর্থ দিয়ে দেশের শিশুরা সাঁতার, অ্যাথলেটিকস কিংবা ফুটবলের প্রশিক্ষণ পেতে পারত, তা ভাগাভাগি হয়েছে কর্মকর্তাদের মধ্যে। নকল ভাউচার, ভুয়া মাস্টাররোল, সাদা কাগজে লেখা বিলসব মিলিয়ে এই প্রকল্প হয়ে উঠেছে অর্থ লুটের একঝুঁকিমুক্ত পদ্ধতি

ক্রীড়ার উন্নয়ন নয়, বরং ক্রীড়া পরিদপ্তর আজ দুর্নীতির এক কুখ্যাত কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অথচ এখান থেকেই দেশের খেলাধুলার ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠার কথা ছিল। এখন প্রশ্ন হলো, কবে থামবে এই অনিয়ম, কবে পাবে খেলোয়াড়রা তাদের প্রাপ্য সুযোগ?  সূত্র :কালবেলা